১৫ ই আগস্ট এর ইতিহাস। স্বপরিবারে ববঙ্গবন্ধু হত্যা ও আদর্শিক পটপরিবর্তন
আসসালামু আলাইকুম,, প্রিয় পাঠক এবং পাঠিকা বৃন্দ,, আজ আমি আপনাদের সাথে আলোচনা করবো ১৫ ই আগস্ট এর ইতিহাস নিয়ে। স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয় ১৫ ই আগস্ট,, আপনারা অনেকেই ১৫ ই আগস্ট এর ইতিহাস সম্পর্কে জানেন না,, এই পোস্টের মাধ্যমে আপনারা জেনে নিতে পারবেন ১৫ ই আগস্ট এর ইতিহাস সম্পর্কে। চলুন শুরু করা যাক........
১৫ ই আগস্ট এর ইতিহাস। স্বপরিবারে ববঙ্গবন্ধু হত্যা (The Murder of Bangabandhu and his Family and the Ideological Turn-around)
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন বিভিন্ন সমস্যা কাটিয়ে দেশকে একটি সম্মান জনক স্থানে নিয়ে যাচ্ছিলেন তখনই এ দেশের স্বাধীনতা বিরোধী চক্র এবং দেশি বিদেশি চক্রান্তকারীরা তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু আওয়ামীলীগ সহ সকল দল বাতিল করে একটি মাত্র বৈধ রাজনৈতিক দল ‘বাকশাল' গঠন করেন। ফলে দ্রুত দেশের সামগ্রিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ঠিক এমনি সময় তিনজন বরখাস্তকৃত সামরিক অফিসারসহ ২০ -- ৩০ জন মেজর ও ক্যাপ্টেন সাজোয়া বাহিনীর প্রায় ১৪০০ সৈন্যের সমর্থনে ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকান্ড ঘটায়। ২০ এ হত্যাকান্ডে খন্দকার মোশতাক আহমদসহ কতিপয় মার্কিন পন্থী আওয়ামীলীগ নেতাও জড়িত ছিল। ২১ বস্তুত বঙ্গবন্ধু হলেন প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ দুই পরাশক্তির মধ্যে ঠান্ডা লড়াই (Cold war) জনিত বিশ্ব রাজনীতির শিকার । এই নৃশংস হত্যাকান্ড থেকে বঙ্গবন্ধুর ১০ বছরের সন্তান শেখ রাসেলও রক্ষা পায়নি। তারা এ সময় আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, শেখ ফজলুল হক মনিসহ তাদের পরিবারের অনেককে হত্যা করেন। এমনকি শেখ মনির অন্তসত্ত্বা স্ত্রীকেও হত্যা করে । শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর ২ কন্যা বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে যান ।
বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার পর খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতি হন এবং বঙ্গবন্ধুর সময়ের মন্ত্রিসভার অনেক মন্ত্রীকে তাঁর মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করেন । তাই প্রথমে একে আওয়ামীলীগের একটি অংশের ক্ষমতা দখল বলে চালাতে চেষ্টা করে। এ সময় খন্দকার মোশতাক সংসদ ও সংবিধান বাতিল না করে একটি বেসামরিক অভ্যূত্থানের রূপ দেয়ার চেষ্টা করে । তিনি 'বাকশাল' বাতিল করেন । এমনকি ট্যাংকে চড়ে মোশতাক আহমেদ ক্ষমতায় গেলেও সামরিক শাসন জারি করে নি। তবে যদি বেসামরিক লোকদের দ্বারাই ক্ষমতা দখল হতো তবে রাষ্ট্রপতি হবার কথা তৎকালিন উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের, মোশতাকের নয়। তাই মাত্র ৫ দিন পর ২০ আগস্ট মার্শাল'ল জারির মাধ্যমে আসল রূপ বেরিয়ে আসে। খন্দকার মোশতাক ১৯৭১ সালেই চেয়েছিল পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশণ করে একত্রে থাকার। যদিও তার সে চেষ্টা সফল হয়নি। পরে ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতি মোশতাক ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স নামে সংবিধানে আইনের শাসন ও মানবতা বিরোধী একটি অধ্যাদেশ জারি করে ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতদের রক্ষার চেষ্টা করেন। যদিও ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ (রহিতকরণ) আইন পাশের মাধ্যমে তা বাতিল হয়ে যায় এবং বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচার হয়। ২২ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম. মুনসুর আলী, ও এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করা হয়।
২৪ আগস্ট জেনারেল সফিউল্লাহকে সরিয়ে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত করা হয়। ৩১ আগষ্ট রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করে এক অধ্যাদেশ জারি করা হয়। ৩ নভেম্বর বন্দী অবস্থায় জেলখানায় জাতীয় ৪ নেতাকে হত্যাকরা হয়। ৩ নভেম্বর বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে এক সেনা অভ্যুত্থান ঘটে। ৫ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি মোশতাক আহমদ আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ৬ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এ. এস. এম সায়েম নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। অতপর ৭ নভেম্বর পাল্টা এক সেনা অভ্যূত্থানে খালেদ মোশাররফ কয়েকজন সহযোগীসহ নিহত হন এবং জেনারেল জিয়ার উত্থান ঘটে। রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সায়েম প্রধান | সামরিক আইন প্রশাসক এবং তিন বাহিনীর প্রধানগণ উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। ১৯৭৬ সালের ৩০ নভেম্বর জেনারেল জিয়া রাষ্ট্রপতি সায়েমের পরিবর্তে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বিচারপতি সায়েম স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন এবং জেনারেল জিয়া রাষ্ট্রপতির পদও দখল করেন। জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় এসেই কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দেন। এ সময় জেনারেল জিয়ার বিরুদ্ধে – স্বপক্ষে ২০ বার সামরিক অভ্যূত্থান ঘটে। এ সকল অভ্যুত্থানের অভিযোগে সেনাবাহিনীর বহু সংখ্যক জোয়ানকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয় ।
জেনারেল জিয়া ১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই রাজনৈতিক দল বিধি বা পি-পি-আর এর ঘোষণা-দেয় । ২২ এ বিধি অনুযায়ী রাজনৈতিক দলগুলোকে সরকারের কাছ থেকে বৈধভাবে সনদ লাভ করতে হয়। এ ভাবে প্রথমে ২১ টি
দলকে ঘরোয়া রাজনীতি করার অনুমতি দেয়া হয়।
১৯৭৭ সালের ৩০ মে দেশব্যাপী প্রথম বারের মত এক গণভোটের আয়োজন করা হয়। এতে জিয়ার উপর আস্থা আছে কি নাই সে বিষয়ে জনগণের মতামত নেয়া হয়। ভোটে শতকরা ৯৮.৮৮ ভাগ হ্যাঁ সূচক ফলাফল দেখানো হয় । ২৩
অতপর জেনারেল জিয়া উৎপাদনের রাজনীতি হিসেবে আখ্যায়িত করে ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। আর এ কর্মসূচি নিয়ে ৪ সপ্তাহব্যাপী সারা দেশজুড়ে এক গণসংযোগে বের হন এবং ৭০ টি জনসভায় তা প্রচার করেন।
১৯৭৭ সালের জানুয়ারি মাসে ৪৩৫২ টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং আগস্টে ৭৮ টি পৌরসভার নির্বাচন হয়। ১৯৭৮ সালের ৩ জুন দেশে প্রথমবারের মত রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করা হয়। কারণ জে. জিয়া ছিলেন তখনও সেনাপ্রধান এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। এর সঙ্গে ৫ টি দল নিয়ে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট নামে একটি নির্বাচনী জোট গঠন করা হয়। আর এই জোটের পক্ষ থেকে জে. জিয়াকে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী করা হয় ।
অপরদিকে,আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে অপর ৫ টি দলের সমন্বয়ে গণতান্ত্রিক ঐক্য জোট গঠিত হয়। এই জোটের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এম. এ. জি ওসমানিকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী করা হয়। নির্বাচনে জেনারেল জিয়া জয়ী হন।
১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ৩১ টি দল অংশ নেয়। ৩০০ আসনের মধ্যে বি এন পি ২০৭ টি এবং আওয়ামীলীগ ৩৯ টি আসনে জয়লাভ করে। ২ এপ্রিল সংসদের অধিবেশন বসে এবং ৬ এপ্রিল থেকে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করা হয়। এ ভাবে জেনারেল জিয়া বেসামরিকীকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন ।
জে. জিয়া সংবিধানের ৫ম সংশোধনী এনে সামরিক শাসনকে বৈধতা দেন এবং রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনেন। যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করে এদেশের মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল তা বাতিল করে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ব্যবস্থা করে। সমাজতন্ত্রের পরিবর্তে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার অর্থে সমাজতন্ত্র নামকরণ করেন এবং ধর্ম নিরপেক্ষতার পরিবর্তে সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস প্রতিস্থাপন করেন। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক সেনা অভ্যূত্থানে জে. জিয়া নির্মমভাবে নিহত হন। এভাবে তাঁর সাড়ে পাঁচ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে।
শিক্ষামূলক ব্লগ বিডির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url